ডুবে যাওয়ার শত বছর পেরোলেও টাইটানিক জাহাজ নিয়ে কখনোই মানুষের আগ্রহে ভাটা পড়েনি। বিখ্যাত এই জাহাজডুবির ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র ও টিভি অনুষ্ঠান। আটলান্টিকের অতল গর্ভে ডুবে যাওয়া জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে আবার মাঝেমধ্যেই আলোড়ন উঠত।

এ পর্যন্ত অনেক ছবি ও ভিডিও তোলা হয়েছে সাগরতলে পড়ে থাকা ক্ষয়িষ্ণু টাইটানিকের। এবার আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা হলো জাহাজটির ধ্বংসাবশেষের এমন কিছু ছবি যেগুলো মানুষকে বিমোহিত করার পাশাপাশি টাইটানিক সম্পর্কে আরো তথ্য দেবে।

সাগরপৃষ্ঠের ১২ হাজার ৫০০ ফুট নিচের অতল অন্ধকারে পড়ে থাকা টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের প্রথম পূর্ণ আকারের ডিজিটাল স্ক্যান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক উপায়ে জাহাজটি আরো বিস্তারিতভাবে দেখা যাচ্ছে। জায়গাটির পানি সেচে শুকিয়ে ফেললে ধ্বংসাবশেষ যেমন দেখা যাবে, ঠিক তেমনটাই উঠে এসেছে ছবিগুলোতে।

আশা করা হচ্ছে, ১৯১২ সালে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের দুর্ঘটনার সময় ঠিক কী হয়েছিল সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজায় নতুন আলোকপাত করবে এসব ছবি।

তৈরি হওয়ার পর প্রথম সমুদ্রযাত্রায় ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক রওনা হয়েছিল টাইটানিক। উত্তর আমেরিকার উপকূলের কিছু দূরে থাকতেই ১৫ এপ্রিল হিমশৈলের (সাগরে ভাসমান বিশাল বরফখণ্ড) সঙ্গে আঘাত হানার পর জাহাজটি ধীরে ধীরে ডুবে যায়। দুই হাজার ২০০ যাত্রী আর কয়েক শ কর্মীর মধ্যে এক হাজার ৫০০ জনের বেশি মারা যায়।

টাইটানিক বিশ্লেষক পার্কস স্টিফেনসন এ নিয়ে বলেছেন, ‘জাহাজটি সম্পর্কে এখনো কিছু মৌলিক প্রশ্ন আছে যার উত্তর জানা দরকার। অনুমাননির্ভর না হয়ে প্রমাণভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথম বড় পদক্ষেপ ত্রিমাত্রিক মডেলটি।’

টাইটানিকের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯০৭ সালে। পাঁচ বছর একটানা কাজ করে ১৯১২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। ব্রিটিশ শিপিং কম্পানি ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ নির্মাণ করে জাহাজটি। ৬০ হাজার টন ওজন এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজটি নির্মাণ করতে সে সময়ই খরচ হয়েছিল ৭৫ লাখ ডলার।

১৯৮৫ সালে সাগরতলে ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে টাইটানিক নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। কিন্তু জাহাজের কাঠামোটি এতই বড় যে অত গভীর অন্ধকার সাগরতলে ক্যামেরা সামান্য অংশই দেখাতে পারে। পুরো চিত্র কখনোই নয়। ডিজিটাল স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে সে সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব হয়েছে।

এবার সম্পূর্ণরূপে ধারণ করা গেছে ধ্বংসাবশেষটি। গভীর সমুদ্রে ম্যাপিং করা কম্পানি ম্যাগেলান লিমিটেড ২০২২ সালে এই স্ক্যানিং করে। তারা প্রকল্পটি সম্পর্কে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেছে।

দূর নিয়ন্ত্রিত ডুবোজাহাজের সাহায্যে বিশেষজ্ঞরা ২০০ ঘণ্টা ব্যয় করেছেন জাহাজের কাঠামোটি খতিয়ে দেখতে। তাঁরা সব ধরনের কোণ থেকে তোলা সাত লাখ ছবির মাধ্যমে টাইটানিকের হুবহু ত্রিমাত্রিক রূপ তুলে ধরেছেন।

টাইটানিকের সামনের অংশটি মরিচায় ঢেকে গেছে। তবে শত বছর পরও তা প্রথম দর্শনেই চেনা যায়। অন্যদিকে পেছনের অংশ সমুদ্রের তলার মাটিতে ধাক্কা খাওয়ায় ভেঙে গেছে। আশপাশে জাহাজের অনেক জিনিস এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এসবের মধ্যে আছে জাহাজের নকশা করা ধাতুর কাজ, মূর্তি আর শ্যাম্পেনের বোতল। রয়েছে বেশ কিছু জুতাসহ ব্যক্তিগত জিনিসও।

টাইটানিক নিয়ে অনেক বছর ধরে গবেষণা করা পার্কস স্টিফেনসন জানান, ১৯১২ সালের সেই দুর্ভাগ্যের রাতে কী ঘটেছিল সে বিষয়ে নতুন ধারণা পাওয়া যেতে পারে এসব ছবি বিশ্লেষণ করে। স্টিফেনসন বলেন, ‘হিমশৈলের সঙ্গে সংঘর্ষের ধরনটি আমরা এখনো ভালো করে বুঝতে পারিনি। এমনকি এখনো জানা যায়নি হিমশৈলটি জাহাজের স্টারবোর্ডের পাশে আঘাত করেছিল কি না, যেমনটা চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে।

সমুদ্রের তলায় থাকা ধ্বংসাবশেষটি ধীরে ধীরে আরো ক্ষয়ে যাচ্ছে। টাইটানিকের বিপর্যয়ের রহস্য সম্পূর্ণরূপে উদঘাটনের সময়ও ফুরিয়ে আসছে। তবে স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা ধ্বংসাবশেষগুলোর খুঁটিনাটিও খতিয়ে দেখতে পারবেন। মনে করা হচ্ছে, টাইটানিকের আর কিছুই শেষ পর্যন্ত গোপন থাকবে না। সূত্র : বিবিসি

1
নিমজ্জিত টাইটানিকের একাংশ। ছবি : বিবিসি

বাংলা উক্তি