এই পোস্টটি লিখেছেন মেনা অঞ্চলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমিতি ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ প্রচারকারী স্বাধীন অলাভজনক সংস্থা উপসাগরীয় মানবাধিকার কেন্দ্রের (জিসিএইচআর) নির্বাহী পরিচালক খালিদ ইব্রাহিম।

এই নিবন্ধটি কাতারের নারী মানবাধিকার সুরক্ষক নূফ আল-মাদিদের জন্মভূমি থেকে প্রস্থান, পরবর্তী প্রত্যাবর্তন ও বর্তমান অন্তর্ধান দিয়ে শুরু যাত্রাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করে।

নিখোঁজের আগে আল-মাদিদ তার এক্স (আগেকার টুইটার) প্রোফাইলে তার অবস্থা হালনাগাদ করতে গিয়ে লেখেন, “স্বদেশে ফিরে আসা এক মূর্খ।”

আল-মাদিদ ২৪ বছর বয়সে বুঝতে পারেন তার পরিবার, বিশেষ করে তার বাবাসহ কাতারি নারীদের উপর আরোপিত বৈষম্য থেকে মুক্ত হতে পালানোই একমাত্র অবলম্বন। একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ৪ আগস্ট, ২০২০ তিনি ২৬ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে ভ্রমণের অনুমতি পেতে তার বাবার ফোন ব্যবহার করে তার অজান্তে ইউক্রেন হয়ে কাতার থেকে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যাওয়ার কথা বর্ণনা করেন।

যুক্তরাজ্যে পৌঁছেই তিনি পারিবারিক সহিংসতা ও তাকে সুরক্ষা দিতে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার উল্লেখ করে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের একটি আবেদন জমা দেন। জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি মুক্ত অনুভব করেন।

“স্বপ্ন পূরণ” শিরোনামের একটি পডকাস্টে তিনি তিনি তার পালানো এবং বেঁচে থাকার স্বপ্ন অর্জন করতে পারা নিয়ে আলোচনা করেন, যেই অভিজ্ঞতাকে তিনি একটি অলৌকিক মনে করেন। পথে বাধা সত্ত্বেও তিনি আশা বজায় রাখার এবং নিজের লক্ষ্যের দিকে দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হওয়ার গুরুত্বের উপর জোর দেন।

কাতারে নারী অধিকার সুরক্ষা
যুক্তরাজ্যে থাকার সময় আল-মাদিদ নিজেকে কাতারি নারী অধিকারের সমর্থক হিসেবে উপস্থাপন করে পুরুষ অভিভাবকত্বের ক্ষতিকর প্রভাবের উপর আলোকপাত করেন; বর্তমানে কাতার পুরুষ অভিভাবকত্ব আইন থাকা উপসাগরীয় অঞ্চলের একমাত্র অবশিষ্ট দেশ। তিনি কীভাবে এই ব্যবস্থা নারীদের পুরুষ অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া কাজ বা ভ্রমণ করতে এবং ঘরোয়া সহিংসতার শিকার নারীদের সামান্য সুরক্ষা পেতে বাধা দেয় তা ব্যাখ্যা করেন।

বিভিন্ন টেলিভিশন সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য ভিডিও রেকর্ডিংয়ে তিনি কাতারে গার্হস্থ্য সহিংসতার ব্যাপকতা ও নারীদের কর্মসংস্থান ও আবাসন অধিকারকে প্রভাবিত করা বৈষম্যমূলক আইনের কারণে তিনি নিরাপত্তার ক্ষতি অনুভব করেছেন তা জানান।

আল-মাদিদ উল্লেখ করেন ১৮ বছরের বেশি বয়সী অবিবাহিত নারীরা কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে ভ্রমণ করতে, সরকারি চাকরি পেতে বা স্বাধীন আবাসনের জন্যে ঋণ পেতে পারে না। তিনি আটক কেন্দ্রের মতো মানসিক প্রতিষ্ঠান, কারাগার বা নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা নিজেদের স্বাধীনতা প্রকাশের চেষ্টাকারী কিছু যুবতী নারীর দুর্ভাগ্যজনক ভাগ্যের কথাও উল্লেখ করেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও জোরপূর্বক গুম
আল-মাদিদ আশ্রয়ের অনুরোধ প্রত্যাহার করে কাতারে ফিরে যাওয়ার অভিপ্রায়ে ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে যুক্তরাজ্য ছেড়ে চলে যান। তিনি কাতারি কর্তৃপক্ষ ফিরে আসার পর তার মানবাধিকারের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও সম্মান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা ব্যাখ্যা করেন।

তবে কাতারে ফিরে আসার পর তিনি তার জীবনের হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সুরক্ষা চান। শীঘ্রই তিনি সাহায্যের অভাব সম্পর্কে প্রকাশ্যে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

ইনস্টাগ্রামে তার ভাগ্য সম্পর্কে একটি বিশেষ উদ্বেগজনক আশংকার একটি ভিডিও পরে সরিয়ে নেওয়া হয়। তিনি ১২ অক্টোবর, ২০২১ তারিখের ভিডিওতে তিনি নিজের পরিবার থেকে হত্যার চেষ্টার শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

আল-মাদিদ ১৩ অক্টোবর, ২০২১ সন্ধ্যায় সামাজিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন বন্ধ করার পর থেকে প্রায় তিন মাস ধরে তাকে শোনা যায়নি। এটি ব্যাপক উদ্বেগ ও আশংকাজনক প্রতিবেদনের সূত্রপাত করে হয়তো তাকে অজ্ঞাত স্থানে আটক বা এমনকি হত্যা করা হয়েছে।

উপসাগরীয় মানবাধিকার কেন্দ্রের (জিসিএইচআর)মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলির প্রচেষ্টাসহ আন্তর্জাতিক চাপের পাশাপাশি আসন্ন ২০২২ বিশ্বকাপের উদ্বোধন আল-মাদিদের ভাগ্য উন্মোচন করতে এবং তার নাগরিক ও মানবাধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে কাতারি কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে। তিনি ৯ জানুয়ারি, ২০২২ তারিখে নিরাপ্দে ও ভালো আছেন নিশ্চিত করে সংক্ষিপ্ত ভিডিও সম্বলিত একটি টুইট পোস্ট করেন।

আল-মাদিদ ১৮ মার্চ, ২০২৩ তারিখে “স্বদেশে ফিরে আসা এক মূর্খ” ক্যাপশন দিয়ে তার এক্স অ্যাকাউন্টসহ বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম নেটওয়ার্কে ভিডিওর একটি ধারাবাহিক প্রকাশ করেন। এই ভিডিও রেকর্ডগুলি কুখ্যাত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যন্ত্রের নেতৃত্বে কর্তৃপক্ষের হাতে তার নাগরিক ও মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘনের যথেষ্ট প্রমাণ দেয়। এই সত্তাটি আইনি কাঠামোর বাইরে কাজ এবং নিরপরাধ নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার হাতিয়ার হিসেবে কাতারের বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার জন্যে পরিচিত।

এই রেকর্ডগুলিতে আল-মাদিদকে দৃশ্যত দুর্বল, চোখে অশ্রুসহ আবেগগতভাবে ব্যথিত ও গুরুতর বিষন্ন দেখা গেছে।

এই রেকর্ডগুলির একটিতে তিনি তার দেশে ঘটমান সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন ও উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতির মধ্যে একটি তীব্র তুলনা চিত্রিত করেন৷ অন্য একটি মর্মস্পর্শী রেকর্ডে তিনি সরাসরি কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করেন, “আমাকে ঘৃণাই যদি করেন, কেন আপনি আমাকে যেতে দেন না আর আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন?”

নূফ আল-মাদিদের ১৮ মার্চ, ২০২৩ তারিখের চূড়ান্ত ভিডিওটিতে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় তার হৃদয় উগড়ে দিয়ে তার অবশিষ্ট কিছুই নেই বলে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

তৃতীয় রেকর্ডটিতে তিনি বলেছেন, “এখন আমি জানি জায়গাটি দুর্গন্ধময় বলে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম।” বিশেষভাবে বেদনাদায়ক চতুর্থ গুরুতর রেকর্ডে তিনি অশ্রুসিক্তভাবে ব্যাখ্যা করেন তিনি তার উপর আরোপিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধের সময় কীভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার কিছু কর্মচারী তাকে ব্ল্যাকমেইল করে তাদের সাথে দেখা করতে বলে। তিনি মিটিংটি তাদের অফিসে হবে কিনা জিজ্ঞাসা করলে তারা রহস্যজনকভাবে উত্তর দেয়, “দ্বিতীয় কোনো একটি স্থানে।”

এই রেকর্ডগুলি আল-মাদিদের ভাগাভাগি করা চূড়ান্ত হালনাগাদ হিসেবে চিহ্নিত, কারণ এরপরে তার সম্পর্কে সমস্ত খবর বা তথ্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।

নূফ আল-মাদিদ কোথায়?
দুঃখজনকভাবে, জিসিএইচআরের কাতারি সরকার ও লন্ডনসহ দূতাবাসগুলি থেকে আশ্বাস পাওয়ার অবিরাম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সবকিছু ব্যর্থ হয়েছে।

বাইরের বিশ্বের সাথে আল-মাদিদের অবাধ যোগাযোগ নিশ্চিত করে কাতারি কর্তৃপক্ষের তার জীবিত থাকার যাচাইযোগ্য প্রমাণ সরবরাহ করা একান্ত অপরিহার্য। তাকে যেকোনো ধরনের আটকাবস্থা থেকে মুক্তি করে তিনি চাইলে তাকে দেশের বাইরে ভ্রমণের স্বাধীনতা দিতে হবে। বর্তমানে পাওয়া সকল তথ্য দৃঢ়ভাবে নির্দেশ করে আল-মাদিদের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা গুরুতর ঝুঁকির মুখে।

জিসিএইচআর অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে, বিশেষ করে জাতিসংঘের প্রক্রিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলিসহ কাতারের প্রভাব বিস্তারকারী সরকারগুলিকে পদক্ষেপ গ্রহণের এবং কাতার কর্তৃপক্ষের উপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে৷

আল-মাদিদের নিরাপত্তা ও কাতারে তার স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার নিশ্চিতের জন্যে এই চাপ প্রয়োজন। কাতার সরকার সক্রিয়ভাবে সত্যের সন্ধানকারী বৈশ্বিক জনমতকে উপেক্ষা করতে পারে না। এর অব্যাহত নীরবতাকে নিঃসন্দেহে আল-মাদিদের পরিস্থিতির স্পষ্ট অবনতি হিসেবে দেখা হবে। নুফ আল-মাদিদসহ তার নাগরিকদের কল্যাণ সুরক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাতারেরই।

বাংলা উক্তি