৫০ বছর আগে মাত্র দেড় মাস বয়সে মায়ের কোল থেকে নরওয়ে যেতে বাধ্য হওয়া এলিজাবেথ ফিরোজা ফিরলেন তার মায়ের কাছে। যদিও জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে পেতে এলিজাবেথের এই যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না।
সম্প্রতি নরওয়ে থেকে শেকড়ের খোঁজে বাংলাদেশে আসেন এলিজাবেথ। শুরু করেন মাকে খুঁজে পাওয়ার এক অসম্ভব লড়াই। তার এই লড়াইয়ে পাশে দাঁড়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদফতর ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ।

১৯৭৫ সালে গুটি বসন্তে স্বামীকে হারান মাত্র ১৩ বছর বয়সী কিশোরী মা ফিরোজা বেগম। দেড় মাস বয়সী মৌসুমিকে শিশু সদনে দিয়ে আসেন অসহায় ফিরোজা। সেখান থেকে তাকে দত্তক নেয় নরওয়ের রয়-রেড দম্পতি। মৌসুমির নাম হয় এলিজাবেথ। ৫০ বছর পর বৃহস্পতিবার মাদারীপুরের শিবচরের পদ্মেরচর গ্রামে জন্মদাত্রী সেই মায়ের দেখা পেলেন এলিজাবেথ।

নরওয়ের আরেন্ডাল শহরে স্বামী হেনরিক ফাজালসেট আর চার সন্তান নিয়ে বাস করেন প্রায় ৫০ বছর বয়সী এলিজাবেথ ফিরোজা ফাজালসেট। কিছুদিন আগেই বড় ছেলে থিও বিয়ে করেছেন। এলিজাবেথ পেশায় একজন স্বাস্থ্যকর্মী। আরেন্ডালেরই একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটালেও এলিজাবেথের মনে অন্যরকম এক হাহাকার।

এলিজাবেথ জানেন না কার গর্ভে তার জন্ম হয়। শুধু জানেন, জন্মদাত্রী মায়ের নাম ফিরোজা বেগম, বাবা মৃত বশির সরদার। জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। আর এই তথ্যও তিনি পেয়েছেন প্রথম পাসপোর্ট আর নরওয়ের দত্তক নেয়া পরিবারের কাছে থাকা দলিল থেকে।

এলিজাবেথ ওরফে মৌসুমী নরওয়েতে দত্তক সন্তান হিসেবে যাওয়ার পর আক্ষরিক অর্থেই নতুন জীবন পেয়েছিলেন। পাসপোর্টে যার নাম ছিল মৌসুমী। নতুন দেশে গিয়ে নাম পাল্টে হয় এলিজাবেথ ফিরোজা রয়েড। অবশ্য ফিরোজা নামটি এসেছে পাসপোর্টে থাকা মা ফিরোজা বেগমের নাম থেকে। বিয়ের পর পেয়েছেন ফাজালসেট পদবী।

মৌসুমী থেকে এলিজাবেথ রয়েড

১৯৭৫ এর জুলাই মাসের ১৫ তারিখ সকালে জন্ম হয় মৌসুমীর। বাবাহারা ১৩ বছরের কিশোরী ফিরোজা বেগম হয়ে পড়েন দিশেহারা। নবজাতক সন্তানকে কী করে বড় করবেন সে চিন্তায় তিনি পাগলপ্রায়। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি। তখন এক প্রতিবেশী তাকে পরামর্শ দেন সমাজকল্যাণ অধিদফতরে শিশু সদনে শিশুটিকে দিয়ে দেওয়ার। ৭৫ সালে ৩০ আগস্ট ঢাকায় সমাজসেবা অধিদফতরের শিশু সদনে দেড় বয়সী শিশুকে বিনা শর্তে দিয়ে যান ফিরোজা বেগম। কখনো আর ভাবেননি মেয়েকে ফিরে পাবেন।

অন্যদিকে ডাক্তার রয় রয়েড আর তার স্ত্রী ক্যারেন রয়েড একটি আবেদন করে বাংলাদেশ সরকারের আন্তঃদেশীয় দত্তক প্রকল্পে সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে। ৭৫ সালের ১৭ জুলাই আবেদন করে তারা একটি শিশু সন্তান চান। সংযোগ ঘটে রয়-রযেড দম্পতির সঙ্গে মৌসুমীর। এরপর চুক্তি, দুই দেশের মধ্যে কাগজপত্র লেনদেন আর পাসপোর্ট করে চার মাস বয়সী ছোট্ট মৌসুমী পাড়ি জমায় নরওয়ে। নতুন নাম হয় এলিজাবেথ ফিরোজা রয়েড।

চিকিৎসক রয় রয়েড আর গৃহিনী মা ক্যারেন এলিজাবেথের কাছে যত্নে বড় হতে থাকেন এলিজাবেথ। ১০ বছর বয়সে প্রশ্নের জবাবে দত্তক বাবা-মা জানান, বাংলাদেশের একটি এতিমখানার সিঁড়িতে তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।

অসলো বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করেন এলিজাবেথ ফিরোজা। সেখানেই পরিচয় হেনরির সঙ্গে। নিজে স্বাস্থ্যকর্মী আর ঘর বাঁধেন সমাজকর্মী হেনরির সঙ্গে। ২২ বছর বয়সে প্রথম সন্তান জন্মের আগে ডাক্তার জানতে চান এলিজাবেথের বাবা-মায়ের কোনো অসুখ ছিল কিনা। জানতে চান পরিবারের পুরো ইতিহাস। এলিজাবেথের মনে নতুন করে প্রশ্ন জাগে তার জন্মদাত্রী মা কে? তার পরিবার কোথায়? প্রথম সন্তান জন্মের পর এই প্রশ্নটি আরো কঠিন হয়ে তার সামনে দেখা দেয়। বারবার তার মনে হয় তার মাও তাকে এতখানি প্রসববেদনা নিয়েই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন।

এলিজাবেথের নতুন যুদ্ধ

শুরু হয় মাকে খোঁজার নতুন যুদ্ধ। ২০১৩ সালে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে বার খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাকে। তবে বাংলাদেশি বন্ধু ক্রিস্টোফার কে বলে গিয়েছিলেন আবার আসবেন তিনি। নরওয়েতে বিভিন্ন শিশু সদনে এর জন্য কাজ করতে শুরু করেন। গান গেয়ে শোনান তাদের। ধীরে ধীরে মাকে খোঁজার কাজটি এগিয়ে নেন। নরওয়ের বিভিন্ন দফতরে দত্তক সম্পর্কিত কাগজগুলো জোগাড় করেন। সেখানে বাংলাদেশে তার ঠিকানা সম্পর্কে তেমন কিছুই ছিল না।

কিন্তু তারতো নিজের জন্মদাত্রী কিংবা পরিবারের খোঁজ লাগবেই। জানতেই হবে, কী তার আসল পরিচয়, কেন তাকে দেওয়া হয়েছিল দত্তক, কারা তার আপনজন। চার বছর ধরে টাকা জমান বাংলাদেশে আসার জন্য। গত ২৩ মার্চ আবার আসেন বাংলাদেশে। এরই মধ্যে যোগাযোগ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মোস্তফা জামিল খানের সঙ্গে। সেখান থেকে যান সমাজসেবা অধিদফতরে। সমাজসেবা অফিসার আবু নাঈম খুঁজে বের করেন ৫০ বছরের পুরোনো ফাইল। নতুন করে আশার আলো দেখেন এলিজাবেথ। জানতে পারেন তার গ্রামের নাম পদ্মের চর, ইউনিয়ন মাদবরচর, উপজেলা শিবচর, জেলা ফরিদপুর (যা বর্তমানে মাদারীপুর)।

মা নিয়ে উক্তি বাংলা উক্তি